ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন, যা সাধারণত আইভিএফ (IVF) নামে পরিচিত, একটি চিকিৎসা পদ্ধতি যা স্বাভাবিক গর্ভধারণে অক্ষম দম্পতিদের সাহায্য করে। এই চিকিৎসা পদ্ধতিতে নারীর ডিম্বাশয় থেকে ডিম্বাণু সংগ্রহ করে ল্যাবরেটরিতে শুক্রাণুর সঙ্গে মিলিত করা হয় এবং তারপরে উৎপন্ন ভ্রূণগুলি জরায়ুতে স্থাপন করে গর্ভধারণ প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ করা হয়। ১৯৭৮ সালে প্রথম সফল আইভিএফ শিশু জন্মের পর থেকে এই চিকিৎসা পদ্ধতিটি ব্যাপকভাবে সাড়া পেয়েছে, বিশ্বব্যাপী লক্ষ লক্ষ শিশু জন্মে এর অবদান রেখেছে। যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বছর জীবিত শিশু জন্মের প্রায় ২ শতাংশ এই পদ্ধতির মাধ্যমে ঘটছে।[১]
এটি বিশেষ করে ফ্যালোপিয়ান টিউব ব্লকএজ, কম শুক্রাণুর পরিমাণ, এন্ডোমেট্রিওসিস বা বয়সজনিত উর্বরতা/ ফার্টিলিটি হ্রাসের মতো সমস্যাগুলির কার্যকর সমাধান। এছাড়া এটি সমকামী দম্পতি, একক অভিভাবক এবং কেমোথেরাপির মতো চিকিৎসার আগে উর্বরতা/ ফার্টিলিটি ধরে রাখার জন্যও উপযোগী।
আইভিএফ কিভাবে কাজ করে?
আইভিএফ এককভাবে সকল ফার্টিলিটি জনিত সমস্যার সমাধান নয় বরং এটির সাফল্য নির্ভর করে বয়স, স্বাস্থ্য এবং অন্তর্নিহিত অবস্থার উপর। ৩৫ বছরের নিচের নারীদের জন্য প্রতি সাইকেলে প্রায় ৪৬ শতাংশ জীবিত শিশু জন্ম হার, যেখানে ৩৮-৪০ বছর বয়সীদের জন্য এটি প্রায় ২২ শতাংশে নেমে আসে।[১]
সম্পূর্ণ সাইকেলটি সাধারণত ৪-৬ সপ্তাহ স্থায়ী হয়, যাতে ওষুধ, পর্যবেক্ষণ এবং প্রক্রিয়াসমূহ অন্তর্ভুক্ত। এটি শারীরিক এবং মানসিকভাবে চাপ হলেও, ধাপগুলি বোঝা আইভিএফ যাত্রাকে আরও সহজ করে তুলতে পারে। এখানে ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিক, যুক্তরাজ্যের জাতীয় স্বাস্থ্য পরিষেবা (এনএইচএস) এবং পাবমেড সেন্ট্রালের (পিএমসি) সহকর্মী-পর্যালোচিত নিবন্ধ থেকে নির্ভরযোগ্য নির্দেশিকার ভিত্তিতে আইভিএফ প্রক্রিয়ার রূপরেখা তুলে ধরা হয়েছে [১][২][৩]।
ধাপ ১: ডিম্বাশয়কে উদ্দীপিত করা/ স্টিমুলেশন – ডিম্বাণু উৎপাদন শুরু করা
আইভিএফ-এর যাত্রা শুরু হয় ডিম্বাশয়কে সক্রিয় করার মাধ্যমে, যা ৮ থেকে ১৪ দিন চলে এবং একাধিক ডিম্বাণু সংগ্রহের লক্ষ্য রাখে। প্রতিদিন সিন্থেটিক এফএসএইচ (FSH) (১৫০-৪৫০ আইইউ (IU)) এবং এলএইচ(LH) এর মতো ওষুধ ইনজেকশন দেওয়া হয়, যা ১০-২০টি ফলিকলকে পরিপক্ক করে থাকে স্বাভাবিকের পরিবর্তে।[১][৩] পিসিওএস রোগীদের জন্য লেট্রোজোলের মতো ওরাল ওষুধ কম ডোজ ব্যবহার করে ওএইচএসএস(OHSS)-এর ঝুঁকি কমায়।
পর্যবেক্ষণ বাড়িয়ে দেওয়া হয়: প্রতি ২-৩ দিনে ভ্যাজাইনাল আলট্রাসাউন্ড করে ফলিকলের পরিবর্তন দেখা হয় (লক্ষ্য ১৬-২০ মিমি), সাথে রক্তে ইস্ট্রোজেনের পরিমাণ পরীক্ষা (প্রতি ফলিকলে ২০০-৪০০ পিজি/এমএল)।[২] দুর্বল প্রতিক্রিয়া দেখলে মৃদু স্টিমুলেশন ব্যবহার করা হয়, যা কম সংখ্যক কিন্তু ভালো মানের ডিম্বাণু দেয়।[৩] রিট্রিভালের ৩৬ ঘণ্টা আগে ট্রিগার শট (এইচসিজি ৫,০০০-১০,০০০ আইইউ বা জিএনআরএইচ অ্যাগোনিস্ট) দিয়ে পরিপক্কতা শেষ করা হয়, যা এলএইচের মতো কাজ করে।
পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া? ইস্ট্রোজেনের মাত্রা বৃদ্ধির ফলে পেট ফোলা, মাথাব্যথা বা মানসিক পরিবর্তন হতে পারে। এই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া গুলো পানি খেয়ে এবং বিশ্রাম করে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। ২০২৫ সালে এমব্রায়োনিক্সের মতো অ্যাপের এআই অ্যালগরিদমের মাধ্যমে রুগীর চাহিদা অনুযায়ী ডোজ দেয়, যা ডিম্বাণুর সংখ্যা ২০ শতাংশ বাড়াতে পারে। এই ধাপ শক্ত ভ্রূণ তৈরির ভিত্তি গড়ে।
ধাপ ২: ডিম্বাণু সংগ্রহ – প্রক্রিয়ার মূল ধাপ
“ট্রিগার শট” দেওয়ার ৩৬ ঘণ্টা পর একটি হালকা সেডেশনের মাধ্যমে ২০-৩০ মিনিটের একটি প্রক্রিয়ায় ডিম্বাণু সংগ্রহ করা হয়। আল্ট্রাসাউন্ড-নির্দেশিত সুঁচ দিয়ে প্রতিটি ফলিকল থেকে ডিম্বাণু বের করে নেওয়া হয় — গড়ে ১০-১৫ টি ডিম্বাণু মেলে। এরপর ল্যাবে তাৎক্ষণিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পরিপক্ক ডিম্বাণু (মোটের ৮০ শতাংশ) ৩৭°সি-তে কালচার মিডিয়ায় রাখা হয়।
প্রক্রিয়া শেষে ১-২ দিন হালকা ব্যথা বা স্পটিং হতে পারে, যা স্বাভাবিক। সংক্রমণ বা রক্তপাতের ঝুঁকি অত্যন্ত কম (<০.২%)। অনেকে বলেন, এটি দাঁতের ফিলিংয়ের চেয়েও সহজ এবং দ্রুত শেষ হয়। সংরক্ষিত (ফ্রোজেন) ডিম্বাণুর ৯০% পর্যন্ত জীবিত থাকে, যা ভবিষ্যতের জন্য ব্যবহারযোগ্য।
ধাপ ৩: শুক্রাণু সংগ্রহ এবং ফার্টিলাইজেশন
আইভিএফ-এর প্রক্রিয়া শুক্রাণু সংগ্রহ এবং ফার্টিলাইজেশনের মাধ্যমে এগোয়, যা ভ্রূণ গঠনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ডিম্বাণু সংগ্রহের একই দিনে সঙ্গী বা ডোনারের শুক্রাণু নেওয়া হয় এবং “ওয়াসিং” প্রক্রিয়ায় সেন্ট্রিফিউগ করে জীবন্ত শুক্রাণু আলাদা করা হয়—প্রতি ডিম্বাণুর জন্য ৫০,০০০ থেকে ১,০০,০০০টি।[৩]
তারপর ফার্টিলাইজেশন শুরু হয়: স্বাভাবিক শুক্রাণু সাধারণ ইনসেমিনেশন (প্রায় ৭০ শতাংশ সফল) বা কম গতিশীলতা থাকলে আইসিএসআই (৭৫-৮০ শতাংশ সফল), যাতে একটি শুক্রাণু সরাসরি ডিম্বাণুর সাথে মিলিত করা হয়। ১৬-১৮ ঘণ্টার মধ্যে ৬০-৭০ শতাংশ ডিম্বাণুতে প্রোনুক্লিয়াই দেখা যায়, যা ফার্টিলাইজেশনের চিহ্ন। ডোনার শুক্রাণুর ক্ষেত্রে সুক্ষভাবে পরীক্ষা করা হয়, যাতে শুক্রাণু গুলা নিরাপদ থাকে এবং পুরুষের অনুর্বরতার সমস্যা কাটিয়ে ওঠা যায়।[২]
ধাপ ৪: ভ্রূণের বিকাশ এবং ল্যাব কালচার
ফার্টিলাইজেশনের /নিষেকের পর ভ্রূণগুলোকে কম অক্সিজেনযুক্ত ইনকিউবেটরে ৩–৫ দিন পর্যন্ত কালচার করা হয়। এ সময়ে একক কোষ বিশিষ্ট জাইগোট (১ম দিন) ধীরে ধীরে বিভাজিত হয়ে ৩য় দিনে ৬–৮ কোষবিশিষ্ট ক্লিভেজ পর্যায়ে পৌঁছে যায় এবং ৫–৬তম দিনে প্রায় ১০০ বা তার বেশি কোষ নিয়ে ব্লাস্টোসিস্ট গঠন করে। গবেষণায় দেখা গেছে, ব্লাস্টোসিস্ট পর্যায়ের ভ্রূণের গর্ভস্থাপনের সম্ভাবনা প্রাথমিক পর্যায়ের ভ্রূণের তুলনায় প্রায় ৫০% বেশি।
আধুনিক টাইম-ল্যাপস প্রযুক্তি, যেমন EmbryoScope, ভ্রূণকে না সরিয়েই নিরবচ্ছিন্নভাবে পর্যবেক্ষণ করতে সাহায্য করে। পাশাপাশি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) ভিত্তিক গ্রেডিং সিস্টেম সবচেয়ে সক্ষম ভ্রূণটি নির্বাচন করতে সহায়তা করে। ৫ম দিনে Preimplantation Genetic Testing for Aneuploidy (PGT-A) নামে একটি পরীক্ষা করা যেতে পারে, যেখানে ৫–১০টি কোষের নমুনা নিয়ে ক্রোমোজোমজনিত ত্রুটি শনাক্ত করা হয়। এ প্রক্রিয়ায় গর্ভপাতের ঝুঁকি প্রায় ১৫–২০% পর্যন্ত কমে যায়।
সুস্থ ভ্রূণগুলোকে –১৯৬°C তাপমাত্রায় বিশেষভাবে হিমায়িত করে সংরক্ষণ করা হয়, যাকে vitrification বলা হয়। এই পদ্ধতিতে ভ্রূণগুলোকে খুব দ্রুত জমাট বাঁধানো হয়, যাতে কোষের কোনো ক্ষতি না হয়। ফলে, গলানোর পর প্রায় ৯৫% ভ্রূণ জীবিত ও কার্যক্ষম থাকে [2]।
ভ্রূণের মান যাচাই করার জন্য “IVF embryo grading” পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়। এতে A বা B গ্রেডের ভ্রূণগুলোকে সর্বোচ্চ মানের হিসেবে ধরা হয়, যা সফলভাবে গর্ভে স্থানান্তরের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত।
ধাপ ৫: ভ্রূণ স্থানান্তর
ভ্রূণ স্থানান্তর সাধারণত নিষেকের ৩–৫ দিন পর করা হয়, যদি তা fresh cycle হয়; আর যদি frozen cycle হয়, তবে এটি কিছুটা পরবর্তী সময়ে সম্পন্ন করা হয়। এর আগে হরমোন থেরাপির মাধ্যমে ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরন দেওয়া হয়, যাতে জরায়ুর অভ্যন্তরীণ স্তর বা endometrium যথাযথভাবে প্রস্তুত হয় এবং এর পুরুত্ব প্রায় ৮–১২ মিলি মিটার হয়।
আল্ট্রাসাউন্ডের মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করে একটি সূক্ষ্ম নল (catheter) ব্যবহার করে খুবই কোমলভাবে এক বা দুটি ভ্রূণ জরায়ুর ভেতরে স্থাপন করা হয়। এই প্রক্রিয়াটি দ্রুত ও ব্যথামুক্ত, এবং এটি অনেকটা Pap test-এর মতো। একাধিক গর্ভধারণের ঝুঁকি (৫% এর নিচে রাখতে) কমানোর জন্য বর্তমানে একক ভ্রূণ স্থানান্তর বা Single Embryo Transfer (SET) পদ্ধতি বেশি পছন্দ করা হয়।
ভ্রূণ স্থানান্তরের পর প্রোজেস্টেরন সহায়তা ১০–১৪ দিন পর্যন্ত দেওয়া হয়, যা যোনিপথে বা ইনজেকশনের মাধ্যমে প্রয়োগ করা যেতে পারে, যাতে luteal phase বজায় থাকে। বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দেন, স্থানান্তরের পর বিশ্রাম নেওয়া উচিত, তবে সম্পূর্ণ শয্যাশায়ী হওয়া প্রয়োজন নেই; হালকা হাঁটাচলা রক্ত সঞ্চালন বাড়ায় এবং ভ্রূণ স্থাপনে সহায়তা করে।
ধাপ ৬: দুই সপ্তাহের অপেক্ষা এবং গর্ভ পরীক্ষা – আইভিএফ চক্রের সমাপ্তি
ভ্রূণ স্থানান্তরের প্রায় ৯–১৪ দিন পর গর্ভধারণ নিশ্চিত করতে beta-hCG নামের একটি রক্ত পরীক্ষা করা হয়। এই পরীক্ষায় হরমোনের মাত্রা যদি ৫ mIU/mL-এর বেশি হয়, তবে তা প্রাথমিকভাবে সফল নিষেকের ইঙ্গিত দেয়; আর যদি ১০০ mIU/mL-এর বেশি হয়, তবে তা নিশ্চিত গর্ভধারণ হিসেবে ধরা হয়।
৬–৭ সপ্তাহের মধ্যে আল্ট্রাসাউন্ডের মাধ্যমে ভ্রূণের হৃদস্পন্দন নিশ্চিত করা যায়। পরীক্ষার ফল ইতিবাচক হলে রোগীকে পরবর্তী obstetric care-এ নেওয়া হয়, আর ফল নেতিবাচক হলে পরবর্তী সাইকেলের জন্য কারণ বিশ্লেষণ করা হয়।
৩৫ বছরের কম বয়সী নারীদের ক্ষেত্রে তিনটি IVF সাইকেল সম্পন্ন করার পর মোট সফলতার হার প্রায় ৬৫% পর্যন্ত পৌঁছায়। এই “দুই সপ্তাহের অপেক্ষা” বা two-week wait সময়ে মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ ও ইতিবাচক মানসিক অবস্থা বজায় রাখা আবেগীয় সুস্থতা ও সামগ্রিক IVF অভিজ্ঞতা উন্নত করতে সহায়তা করে।
IVF-এর মাধ্যমে কি শিশুর লিঙ্গ নির্ধারণ করা সম্ভব?
হ্যাঁ, ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন (IVF) ব্যবহার করে শিশুর লিঙ্গ নির্ধারণ করা সম্ভব। এই প্রক্রিয়ায় Preimplantation Genetic Testing (PGT) বা ভ্রূণের জেনেটিক পরীক্ষা ব্যবহার করা হয়। IVF-এ নারীর ডিম্বাণু সংগ্রহ করে ল্যাবরেটরিতে শুক্রাণুর সঙ্গে নিষিক্ত করা হয়। কয়েক দিনের মধ্যে ভ্রূণ blastocyst পর্যায়ে পৌঁছায় (৫–৬ দিন), তখন কয়েকটি কোষ নিয়ে পরীক্ষা করে দেখা হয় ভ্রূণটি নারী (XX) নাকি পুরুষ (XY)। এর ফলাফলের ভিত্তিতে পছন্দসই লিঙ্গের ভ্রূণ গর্ভে প্রতিস্থাপন করা হয়।
এই প্রযুক্তি খুব উচ্চ নির্ভুলতার সঙ্গে লিঙ্গ নির্বাচন সম্ভব করে। তবে সব দেশই ব্যক্তিগত পছন্দের জন্য লিঙ্গ নির্বাচন অনুমোদন করে না। অনেক দেশে এটি শুধুমাত্র চিকিৎসাগত কারণে বৈধ, যেমন লিঙ্গ-নির্ভর জেনেটিক রোগ প্রতিরোধে, আবার কিছু দেশে যেমন ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রে পরিবার ভারসাম্য রক্ষার জন্য সীমিতভাবে অনুমোদিত।
লিঙ্গ নির্ধারণের পদ্ধতি
শিশুর লিঙ্গ নির্ধারণের দুটি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রধান—Preimplantation Genetic Testing (PGT) এবং শুক্রাণু আলাদা করা (Sperm Sorting)। তবে, শুধুমাত্র PGT-কে সবচেয়ে নির্ভুল এবং নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি হিসেবে ধরা হয়
Preimplantation Genetic Testing (PGT) সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত এবং বিশ্বস্ত পদ্ধতি। এতে IVF-এর মাধ্যমে ভ্রূণ তৈরি করার পর, প্রতিটি ভ্রূণ স্থাপনের আগে পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষা করে দেখা হয় ভ্রূণের ক্রোমোজোমাল স্বাভাবিকতা এবং লিঙ্গ। এই পরীক্ষার নির্ভুলতার হার ৯৯%-এর বেশি, যা এটিকে লিঙ্গ নির্বাচনের সোনালী মানদণ্ড করে তোলে।
Sperm Sorting পদ্ধতিতে নিষিক্ত করার আগে X- এবং Y-ক্রোমোজোমযুক্ত শুক্রাণু আলাদা করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, MicroSort পদ্ধতি ফ্লো সাইটোমেট্রি ব্যবহার করে DNA-এর ভিত্তিতে শুক্রাণু আলাদা করে। তবে, PGT-এর তুলনায় এর নির্ভুলতা অনেক কম এবং এটি অনেক দেশে অনুমোদিত নয়, যেমন যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র
অনেক ভুল ধারণা আছে “প্রাকৃতিক” লিঙ্গ নির্বাচনের বিষয়ে—যেমন নির্দিষ্ট সময়ে গর্ভধারণ, বিশেষ খাবার বা পুরানো কাহিনী। তবে বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা গেছে, এগুলির কোন বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই শিশুর লিঙ্গ নির্ধারণে প্রভাব ফেলার জন্য।
IVF এর মাধ্যমে লিঙ্গ নির্ধারণের পদ্ধতি
IVF-এ লিঙ্গ নির্বাচন সাধারণ IVF প্রক্রিয়ার মতো, তবে একটি মূল পার্থক্য আছে—ভ্রূণ স্থাপনের আগে জেনেটিক পরীক্ষা করা হয়।
প্রথমে হরমোন ইনজেকশনের মাধ্যমে ডিম্বাশয়কে উদ্দীপিত করা/ স্টিমুলেশন (Ovarian Stimulation) করা হয়, যাতে একাধিক পরিপক্ব ডিম্বাণু উৎপন্ন হয়। এরপর একটি ছোট, বহির্বিভাগীয় প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ডিম্বাণু সংগ্রহ করা হয় এবং ল্যাবরেটরিতে শুক্রাণুর সঙ্গে ফার্টিলাইজেশন /নিষিক্ত করে ভ্রূণ তৈরি করা হয়। এই ভ্রূণকে প্রায় পাঁচ দিন blastocyst পর্যায় পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়, যেখানে প্রায় ১০০টি কোষ থাকে।
এরপর এমব্রায়োলজিস্টরা প্রতিটি ভ্রূণ থেকে ৫–১০টি কোষ নিয়ে Preimplantation Genetic Testing (PGT) করে। এই পরীক্ষা ভ্রূণের ক্রোমোজোমাল গঠন নির্ধারণ করে এবং দেখায় ভ্রূণটি পুরুষ (XY) না নারী (XX)। শুধুমাত্র নির্বাচিত লিঙ্গের এবং স্বাভাবিক ক্রোমোজোমযুক্ত ভ্রূণই গর্ভে স্থানান্তরের জন্য বেছে নেওয়া হয়।
নির্বাচিত ভ্রূণকে Ultrasound-নিয়ন্ত্রিত পাতলা, নমনীয় ক্যাথেটারের মাধ্যমে গর্ভে স্থাপন করা হয়। এই ধাপটি দ্রুত, বেদনাহীন এবং প্যাপ টেস্টের মতো। অতিরিক্ত সুস্থ ভ্রূণ –১৯৬°C-এ সংরক্ষণ (vitrification) করা হয়, যা পরবর্তীতে ব্যবহার করার জন্য প্রায় ৯৫% বেঁচে থাকে।
IVF লিঙ্গ নির্বাচনের সফলতার হার
IVF-এর মাধ্যমে লিঙ্গ নির্বাচন অত্যন্ত নির্ভুল, বিশেষ করে Preimplantation Genetic Testing (PGT) ব্যবহার করলে এর নির্ভুলতা ৯৯%-এর বেশি। এর মানে, বাবা-মা যদি ছেলে বা মেয়ের সন্তান পছন্দ করেন, তবে নির্বাচিত ভ্রূণ সেই লিঙ্গের হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় নিশ্চিত।
তবে, লিঙ্গ নির্ধারণের নির্ভুলতা এবং গর্ভধারণের সফলতা একই নয়। সঠিক লিঙ্গ নির্ধারণ প্রায় নিখুঁত হলেও, গর্ভধারণের সফলতা অন্য উপাদানগুলোর ওপর নির্ভর করে—যেমন নারীর বয়স, ডিম্বাণুর মান, এবং জরায়ুর স্বাস্থ্য।
৩৫ বছরের কম বয়সী নারীদের ক্ষেত্রে IVF এবং PGT ব্যবহার করে গর্ভধারণের সফলতার হার সাধারণত প্রতি সাইকেলে ৬০–৭০%। উন্নত ল্যাবরেটরি ও অভিজ্ঞ এমব্রায়োলজিস্টযুক্ত ক্লিনিকগুলিতে এই হার আরও বেশি এবং ফলাফলও বেশি সঙ্গতিপূর্ণ থাকে।
IVF লিঙ্গ নির্বাচনের সফলতায় প্রভাব ফেলা উপাদানসমূহ
IVF-এর মাধ্যমে লিঙ্গ নির্বাচন সফল হবার ক্ষেত্রে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ জৈবিক ও চিকিৎসাগত দিক প্রভাব ফেলে।
- নারীর বয়স: কম বয়সী নারীরা বেশি এবং সুস্থ ডিম্বাণু উৎপন্ন করেন, যা ভালো মানের ভ্রূণ তৈরি করে এবং সফল প্রতিস্থাপনের সম্ভাবনা বাড়ায়।
- ভ্রূণের মান: সব ভ্রূণ বায়োপসি বা ফ্রিজিং-এর পর বেঁচে থাকে না। বেশি মানসম্মত ভ্রূণ থাকলে সফলতার সম্ভাবনা বাড়ে।
- শুক্রাণুর মান: সুস্থ শুক্রাণু, যা ভালো গতিশীলতা ও আকৃতির, তা বেশি ফার্টিলাইজেশন/নিষিক্ত হয় এবং ভ্রূণ উন্নয়নে সাহায্য করে।
- জরায়ুর স্বাস্থ্য: সঠিকভাবে প্রস্তুত জরায়ু, যেখানে এন্ডোমেট্রিয়ামের পুরুত্ব ৮–১২ মিমি, সফল প্রতিস্থাপনের জন্য অপরিহার্য।
- ল্যাব প্রযুক্তি: আধুনিক সরঞ্জাম, উন্নত PGT সুবিধা এবং দক্ষ এমব্রায়োলজিস্ট থাকা ক্লিনিকের নির্ভুলতা ও গর্ভধারণের হার অনেক বেশি।
IVF লিঙ্গ নির্বাচনের সুফল
IVF ব্যবহার করে লিঙ্গ নির্বাচন কেবল পরিবারিক পছন্দের সীমার মধ্যে নেই, এটি গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসাগত এবং মানসিক সুবিধাও প্রদান করে।
- জেনেটিক রোগ প্রতিরোধ: কিছু রোগ যেমন হিমোফিলিয়া এবং Duchenne muscular dystrophy, X-লিঙ্কড এবং প্রধানত ছেলে শিশুতে দেখা যায়। নারী ভ্রূণ নির্বাচন করে এমন জেনেটিক ঝুঁকি থাকা পরিবার এই রোগের সংক্রমণ রোধ করতে পারে।
- পরিবার ভারসাম্য: যারা ইতিমধ্যেই এক লিঙ্গের সন্তান রয়েছে, তারা অন্য লিঙ্গের সন্তান পেতে চাইতে পারে, যাতে পরিবার সম্পূর্ণ হয়।
- সুস্থ গর্ভধারণ: PGT নিশ্চিত করে যে শুধুমাত্র ক্রোমোজোমাল স্বাভাবিক ভ্রূণই গর্ভে প্রতিস্থাপন হয়। এর ফলে গর্ভপাতের সম্ভাবনা কমে এবং সুস্থ গর্ভধারণের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়।
- মানসিক সাচ্ছন্দ্য: অনেক বাবা-মা জানান, তারা পরিবারিক লিঙ্গ পরিকল্পনার সুযোগ পেলে মানসিক চাপ কমে এবং সন্তুষ্টি বৃদ্ধি পায়।
এই সুবিধাগুলি IVF-ভিত্তিক লিঙ্গ নির্বাচনকে কেবল পছন্দের নয়, বরং নিরাপদ, স্বাস্থ্যকর এবং পরিবারিক পরিকল্পনার জন্য কার্যকর পদ্ধতি হিসেবে প্রমাণ করে।
IVF লিঙ্গ নির্বাচনের সম্ভাব্য ঝুঁকি ও অসুবিধা
যদিও IVF-ভিত্তিক লিঙ্গ নির্বাচন অত্যন্ত নির্ভুল, এটি কিছু চিকিৎসাগত, নৈতিক এবং আর্থিক চ্যালেঞ্জও সঙ্গে নিয়ে আসে।
- চিকিৎসাগত ঝুঁকি: IVF-এর সাধারণ ঝুঁকি যেমন ডিম্বাশয় অতিসক্রিয়তা (Ovarian Hyperstimulation), হালকা রক্তপাত, সংক্রমণ বা ডিম্বাণু সংগ্রহের সময় অস্বস্তি থাকতে পারে। এছাড়াও, ভ্রূণ বায়োপসি যদিও নিরাপদ, তবুও মাঝে মাঝে কিছু ভ্রূণ হারানোর সম্ভাবনা থাকে।
- নৈতিক উদ্বেগ: কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করেন, ব্যক্তিগত পছন্দের জন্য শিশুর লিঙ্গ নির্বাচন করলে লিঙ্গভিত্তিক পক্ষপাত তৈরি হতে পারে এবং সামাজিক ভারসাম্যহীনতা বাড়তে পারে। তাই অনেক দেশ শুধুমাত্র চিকিৎসাগত কারণে লিঙ্গ নির্বাচন অনুমোদন করে, ব্যক্তিগত পছন্দের জন্য নয়।
- মানসিক চাপ: IVF প্রক্রিয়া দীর্ঘ ও ব্যয়বহুল হতে পারে। যদি ফলাফল প্রত্যাশা অনুযায়ী না হয়, তবে দম্পতিদের জন্য হতাশা ও মানসিক চাপ বৃদ্ধি পেতে পারে।
- আর্থিক ঝুঁকি: জেনেটিক টেস্টিং সংযোজন করলে খরচ বৃদ্ধি পায়, কারণ এটি উন্নত ল্যাবরেটরি বিশ্লেষণ এবং দক্ষ পেশাদারদের প্রয়োজন।
এই ঝুঁকিগুলি বিবেচনা করে দম্পতিদের পরামর্শ এবং যথাযথ প্রস্তুতি অপরিহার্য।
ইরানে IVF লিঙ্গ নির্বাচন আইনগতভাবে অনুমোদিত কি?
হ্যাঁ, ইরানে IVF-ভিত্তিক লিঙ্গ নির্বাচন আইনগতভাবে অনুমোদিত, তা চিকিৎসাগত বা পরিবারিক ভারসাম্য রক্ষার উদ্দেশ্যে প্রয়োগ করা হোক, তবে অনুমোদিত ফার্টিলিটি সেন্টারগুলিতে এটি করা আবশ্যক। ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নৈতিক নিয়মাবলীর অধীনে এই প্রক্রিয়াটি অনুমোদন করেছে, যা দম্পতিদের পরামর্শ এবং স্বতঃসিদ্ধ সম্মতি নেওয়ার শর্তে প্রযোজ্য।
ইসলামিক বায়োএথিক্যাল দৃষ্টিকোণ থেকে, লিঙ্গ নির্বাচন হালাল গণ্য হয় যদি এটি বৈধ কারণে করা হয়—যেমন জেনেটিক রোগ প্রতিরোধ বা পরিবারিক ভারসাম্য অর্জন, ব্যক্তিগত অভিমান বা বৈষম্যের জন্য নয়। তেহরান, শিরাজ এবং মাশহাদে কয়েকটি ফার্টিলিটি ক্লিনিক উন্নত IVF সেবা, যার মধ্যে PGT অন্তর্ভুক্ত, সরকারি কঠোর তত্ত্বাবধানে প্রদান করে।
এই আইনগত নমনীয়তা ইরানকে মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যে সহায়ক প্রজনন প্রযুক্তিতে সবচেয়ে অগ্রগামী দেশগুলির মধ্যে একটি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
ইরানে IVF লিঙ্গ নির্বাচনের খরচ
ইরানে IVF-ভিত্তিক লিঙ্গ নির্বাচনের খরচ (PGT ব্যবহার করে) পশ্চিমা দেশের তুলনায় অনেক কম [1]। উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাষ্ট্রে একটি পূর্ণ IVF সাইকেল, PGT সহ, সাধারণত $১৫,০০০–২৫,০০০ ডলারের মধ্যে হয়, এবং শুধুমাত্র PGT-এর খরচ আলাদাভাবে $৩,০০০–৬,০০০ ডলার।
এর বিপরীতে, ইরান ২০০৩ সাল থেকে শিয়া-আইন অনুসারে অনুমোদিত লিঙ্গ নির্বাচনের সাথে সাবসিডাইজড ফার্টিলিটি সেবা প্রদান করে, যেখানে ১৫০-এর বেশি স্বীকৃত কেন্দ্র প্রতি বছর ২৫,০০০-এর বেশি সাইকেল সম্পন্ন করে।
TebMedTourism অনুযায়ী, ব্যাপক লিঙ্গ নির্বাচনের প্যাকেজের দাম প্রায় $৩,৫০০–৫,৫০০ ডলার, যা অন্তর্ভুক্ত করে: ovarian stimulation, egg retrieval, ICSI, blastocyst culture, PGT-A (লিঙ্গ ও ক্রোমোজোমাল স্ক্রিনিং), embryo transfer এবং তাৎক্ষণিক ফলো-আপ। পশ্চিমা দেশের তুলনায় এটি প্রায় ৬০–৮০% কম, কারণ শ্রমিক, সুবিধা এবং ঔষধের খরচ কম ($৩০০–৫০০ ডলার)।
মেডিক্যাল ট্যুরিজমের তথ্য অনুযায়ী, এই প্রোগ্রামে ২০–৩০% রোগী আন্তর্জাতিক। ৩৫ বছরের কম নারীদের জন্য লাইভ-বার্থ রেট ৪০–৫০%, যা বৈশ্বিক মানের সাথে সমান।
ফলে, আইনগত অনুমোদন, আধুনিক প্রযুক্তি এবং সাশ্রয়ী খরচ এর কারণে ইরান লিঙ্গ নির্বাচনের IVF-এর জন্য একটি আকর্ষণীয় গন্তব্য।
